বাবুইরা গোয়েন্দা
মো : সাব্বির হাসান
ভোরে আকাশে আলোর লাল আভা,তারপর ধীরে ধীরে চারদিক অন্ধকার থেকে আলোয় ভরে ওঠা,তারপর আবার ধীরে ধীরে অন্ধকারে পরিনত হওয়া,চারদিকে প্রকৃতির অপরুপ সৌন্দর্য,নীল আকাশ,পাখির কলধ্বনি এসব কিছু দেখে ও শুনে দিন কাটত বাবুইয়ের।সে লেখাপড়া করে এবং লেখাপড়ায় বড্ড ভালো।বাবুইয়ের কিছু বন্ধুবান্ধবও ছিল।তাদের সাথে সে তার অবসর সময় কাঁটাত।কখনও খেলাধুলা কখনও গল্পগুজব কখনও খাওয়াদাওয়া এইসবই ছিল তাদের নিত্যদিনকার কাজ।বাবুইয়ের বন্ধুগুলোর নাম ছিল অদ্ভত ধরনের,যেমন কারও নাম বিট্টু,হাসু,নন্দু,পিটার ইত্যাদি।এদের আবার বিভিন্ন জনার বিভিন্ন গুণ রয়েছে।একদিন বিট্টু এসে বলল,”কইতেছিলাম কী বাবুই চল না আমরা একটু ঘুইরা আসি”।কথা শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে এ বাঙাল ভাষায় কথা বলে।তেমনি হাসু একটু আধভাঙ্গা সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে এবং পিটার সে একটু বাংলার মাঝে হঠাৎ ইংরেজী ঢুকিয়ে ফেলে।যাইহোক বাবুই যেহেতু পড়াশুনায় ভালো,তাই সে পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করে।তার বন্ধুরাও মোটামুটি ভালো।একদিন তারা সবাই মিলে দুপুরে হাঁটছিল। হাঁটতে হাঁটতে তারা একটা আমগাছের নিচে আসে।আমগাছটা আকারে ছিল অনেক বড় প্রায় একটা বটগাছের সমান।আমও ধরেছে অনেক।সবার জিহ্বায় ধীরে ধীরে জল আসতে লাগল।হঠাৎ নন্দু বলে উঠল ,”কী রে ভাই তোরা কী কেউ আম খাবি?”সবাই এক বাক্যে হ্যাঁ বলে উঠল।কিন্তু বিট্টু বলল,”মাইষের গাছের অাম না কইয়া খাওয়াটা কী ঠিক হইব”।বাবুই তখন বলল,তুই একটু চুপ কর না,যত সব আজেবাজে কথা,দেখছিস না কাছে পিঠে কেউ নেই,খোলা পাথারের মধ্যে গাছ,কেউ দেখবেই না,গালাগালি থাকল দূরে।কিন্তু ঐ গাছের মালিক ছিল একটু চালাক প্রকৃতির। সে করেছিল কী নিজেই আমগাছে চড়ে একটা ডালের আড়ালে লুকিয়ে ছিল দেখার জন্য যে কে আম চুরি করে।গাছের মালিক মদন মিয়া অন্যমনস্ক হয়ে তাদের কথা শুনছিল এবং মুচকি মুচকি হাসছিল।ছেলেগুলো সবাই হাতে ইট নিয়ে গাছে ছুঁড়ে মারল।কথায় আছে অতি চালেকের গলায় দড়ি।একটা ইট এসে মদনের মাথায় লাগে।আর সে চিৎকার করে গাছ থেকে পড়ে যায়।সকলেরই তখন চক্ষু চড়কগাছ,সকলেই তখন শেয়ালের মতো লেজ গুটিয়ে ছুট দেয়।মদন মিয়াও তাদের পিছনে খোঁড়াতে খোঁড়াতে ছোটে।কিন্তু তাদের সাথে কী আর পারে।তারা একরকম পালিয়ে যায়। পালানোর একসময় নন্দু বলে,খুব বাঁচা বেঁচে গেছি রে,শালা গাছেই যে ছিল কে তা আন্দাজ করতে পারে বলত।একদম রাইট বলেছিস রে নন্দু, এরকম মানুষও হয় যে নাকি গাছে চড়ে আম পাহারা দেয়,পিটার বলল। আমি আগেই কইছিলাম না কইয়া খাওয়া ঠিক হইব না।বাবুই রেগে গিয়ে বলল,থামবি তোরা যা হবার তা তো হয়েই গেছে।বরং চল আমরা বাড়িতে যাই।একদিন বাবুই নির্জন জায়গায় বসে থাকা অবস্থায় গান গাইছিল,
সেই যে হলুদ পাখি,বসে জামরুল গাছের ডালে
করত ডাকাডাকি আমার শৈশবের সকালে
একদিন গেল উড়ে জানি না কোন সুদুরে
ফিরবেনা সে কী ফিরবেনা আর কোনদিন।
বা,বস হাউ নাইস তোমার গান,পিটার বলল।তখন বাবুই বলল,তোরা কী কেউ জানিস গানটার অর্থ কী ? গানটার অর্থ হইতেছে ,এখানে একজনের শৈশবকালের স্মৃতিকে উপস্থাপন করা হইয়াছে,হাসু বলল।তুই ঠিক বলেছিস রে হাসু, কিন্তু একটা জিনিস খেয়াল করে দেখ,এইসব জিনিস আর দেখা যায় না।হলুদ পাখি সে কবেই বিলুপ্ত হয়ে গেছে।আর আগেরকার দিনের গান ছিল কত অর্থপূর্ণ।গানের মাঝে লুকিয়ে থাকত কত উপদেশ,উপমা।আর এখনকার ছেলেমেয়েরা এই সব গান শুনতেই চায় না।ঠিক কইচিস রে বাবুই এখনকার ছেলেমেয়েদের নাকি নেশা,মদ,গাজা হেই সব গান ছাড়া ঘুমই আসে না।তা যা বলেছিস আর তাদেরই বা কী দোষ এখনকার শিল্পীরা তারা নাকি প্রেমে ব্যর্থ হওয়ার পর গানের জগৎে আসে।আর সবাইকে জানায় যে সে কতটা ব্যর্থ।এখান থেকেই নেশার ব্যপারটা আসে।তারা নানা ভাবে এই জিনিস গুলো গানের মাঝে তুলে ধরে। কোমলমতি ছেলেরা এগুলো দেখে ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে যাচ্ছে।ঠিক বুঝলাম না রে বাবুই, নন্দু বলল। দেখ কেউ যদি দিনের বেশিরভাগ সময় কোন একটা জিনিস দেখে বা শোনে,তাহলে তার মনে কৌতূহল জাগে এবং মনে হয় একবার দেখিনা নেশা করে কেমন লাগে।এভাবে ধীরে ধীরে নেশাগ্রস্ত হয়ে নষ্ঠ হয়ে যায়। ব্যাপারটা এবার বুঝতে পেরেছি সবাই এক বাক্যে বলে উঠল।তাদের গল্পগুজব করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে।সবাই তখন একে একে বাড়ি যায়।বাড়ি গিয়ে বাবুই পড়তে বসে।পড়া শেষ করে রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে । ঘুমের মধ্যে বাবুই স্বপ্নের দেশে ভেসে যায়।সেখানে একটি মেয়েকে দেখে হঠাৎ থমকে দাঁড়ায় এবং অপলক মেয়েটির দিকে তাকিয়ে থাকে । যেন মরুভূমিতে একটু বৃষ্টি এসেছে । আর সেই বৃষ্টিতে সে নিজেকে শীতল করছে । কী অপরূপ ছিল মেয়েটির মুখ,টানাটানা দুটো চোখ।তার হাসি দেখলে মনে হয় যেন মরুভূমিতে একটু বন্যা হচ্ছে।আর বন্যার পানিতে সে সাতার কাঁটছে । হঠাৎ তার ঘুম ভেঙ্গে যায় । সে দেখে চারদিক আলোকিত হয়ে গেছে। তবুও স্বপ্নটা যেন তাকে চুম্বকের মতো টানছে। সে হাত মুখ ধুঁয়ে পড়তে বসে, স্কুলে যায়,কিন্তু সবকাজে সে অমনযোগী,শুধু স্বপ্নটার দিকে তার খেয়াল। তার বন্ধুরা এমন অবস্থা দেখে তাকে প্রশ্ন করে,কী রে ভাই তোর কী হয়েছে? তখন সে কিছু বলে না এইরকম কিছু দিন যাওয়ার পর সে স্বপ্নটার কথা ভুলে যায়। সময়টা তখন শীতকাল। সকালে রোদে বসে ওরা গা গরম করছিল। এমন সময় বিট্টু বলল, কইতেছিলাম কী অনেকদিন তো কোথাও বেড়াতে যাওয়া হয় নাই। তাই আমরা হগগোলে মিইলা যদি কোথাও বেড়াতে যাই তাহলে কেমন হয়। তখন বাবুই বিট্টুর সুরে বলল, কথাটা তুই মন্দ কছ নাই। আমার বাকী বন্ধুদের কী মত,সকলেই শুনে খুব খুশি।তখন তারা ঠিক করতে বসল যে কোথায় যাওয়া হবে। প্রথমে বাবুই বলল, আমরা যদি কোন দর্শনীয় স্থান দেখতে যাই যেমন:স্বপ্নপুরী,পাহাড়পুর,ভিন্ন জগৎ। পিটার বলল, আমি তোমাকে সাপোর্ট করছি। এগুলোতে গেলে খুব মজা হবে। ছাই মজা হবে,এগুলোতে দেখার মতো কিছুই নাই, শুধু ঘুরে ঘুরে পা ব্যাথা ধরানো। আমরা বরঞ্চ কোন একটা জমিদার বাড়িতে বা রাজার বাড়িতে যাই। তাহলে আমরা দেখতে পারব তারা কীভাবে জীবনযাপন করতেন। অনেক যুক্তি খন্ডনের পর নন্দুর প্রস্তাবকে ঠিক বলে ধরা হলো এবং সোমবার যাওয়ার দিন ঠিক করা হলো। সকলে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করল। সোমবারের দিন সকালে গাড়ি রওনা হলো। সকলে খুশিতে তো আত্মহারা। এমন সময় বাবুই বলল, আমরা ভ্রমনের পাশাপাশি অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য এসেছি এইটা সবাই মনে রাখিস। রাজার বাড়িতে পৌঁছে সকলে সকালের নাস্তা শেষ করে। তারপর বাড়িটা ঘুরে দেখতে শুরু করে। ওরে ছালা দেখ, বাড়িটা কত বড় আর কত দামি জিনিস দিয়ে সাজানো,মাইরি বল রাজারা হেবি বড়লোক তাই নারে পিটার,নন্দু বলল। তোরা কী কেউ জানস আমি ছোট্টবেলায় শুইনাছি যে, রাজাদের নাকি অনেক ধনসম্পত্তি থাকে,আর হ্যারা তা শঞুঘরে হাত থাইকা বাঁচানোর লাইগা বা মরার আগে নাকি সেইগুলা গুপ্তধণ হিসাবে রাইখা যায়। এ রাজাও তেমনটাই করেন নাই তো রে। বাবুই বলল কথাটা তুই মন্দ বলিস নাই রে বিট্টু, চল তাহলে খুঁজে দেখি কিছু পাওয়া যায় নাকি। সকলেই তখন গুপ্তধণ খুঁজতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। কিন্তু তারা শুধু একা নয় এরকম আরো একদল ছিল যারা সেইসময় একই জিনিস খুঁজছিল। তাদের হাবভাব মোটেই ভালো ছিল না।দেখতে বিদঘুঁটে এবং কালো । তাদের থেকে বয়সে বড়। বাবুইরা আসলে গুপ্তধণের ব্যাপারটা তাদের কাছ থেকেই আড়ি পেতে শুনেছিল। বাবুইরা খুঁজতে খুঁজতে একটা বন্ধ ঘরের সামনে এসে দাঁড়ায়। ঘরটা ছিল অন্ধকারাচ্ছন্ন। সকলে ভয়ে ভয়ে ভিতরে ঢুকল। ঢুকে খুঁজতে খুঁজতে একটা জিনিস হঠাৎ বাবুইয়ের পায়ে লাগল। সে চিৎকার করে উঠল, তারপর সেটাকে হাতে তুলে নিয়ে দেখে যে একটা সোনার কৌটা। বাবুই কৌটটা খুলে দেখে তার মধ্যে একটা কাগজ। আর কাগজটাতে কী যেন একটা লেখা রয়েছে। পরে তারা আলোর কাছে এসে দেখতে পেল যে এটা একটা ছন্দ।
ধণ লোহিতে এসেছ যে
এসো হে আমার কাছে
আছি আমি প্রাসাদ থেকে কিছুদুরে
যাবে পুড়ে বটগাছও আগুণে দিলে।
বাবুই সবাইকে সেটা পড়ে শোনাল। এটা আবার কেমন ধারার ছন্দ,আর এত যত্ন করে সেটা এখানে রাখাই হয়েছে বা কেন,ব্যাপারটা একটু গোলমেলে, নন্দু একটু চিন্তিত হয়ে বলল। আচ্ছা ভাই আমার কী মনে হয় জানস, এইটা হইতেছে সেই জিনিস যেটা আমরা খুঁইজ্জা বেরাইতেছি, বিট্টু বলল। তখন পিটার বলল, তুই অ্যাবছুলেটলি রাইট বলেছিস ভাই,দেখ না কী সব ধণ,প্রাসাদ এসব লেখা। এটা যদি সেই জিনিস হয় তাহলে সাবধান,এটা হয়ত সেই গুপ্তধণের ইঙ্গিত। চল আমরা সবাই এখন প্রাসাদ থেকে বের হই। আর ভুলেও ঐ ছেলেগুলো যেন আমাদের সন্দেহ না করে, বাবুই বলল। এই বলে তারা একটু তাড়াহুড়া করে প্রাসাদ থেকে বের হতে ধরে সেই ছেলেগুলোর সামনে পড়ে এবং কোনরকমে কথা কাটিয়ে পালিয়ে যায়। পরে তারা গিয়ে একটা হোটেলে রুম ভাড়া নেয়। তখন হাসু বলে আমরা বাড়ি যাব না। নারে আমরা এখন বাড়ি যাব না, প্রথমে এই ধাঁধার সমাধান করব। তারপর বাড়ি যাব। তোরা কী বলিস,সকলেই তখন বাবুইয়ের সাথে একমত পোষণ করে । এদিকে ঐ দলের নেতা যার নাম বাচ্চু ভাই। সে একটু চালাক প্রকৃতির। সে বাবুইদের একটু সন্দেহের চোখে দেখে ছিল। এবং তার দলের একজনকে পাঠায় বাবুইদের বিষয়ে খবর নেওয়ার জন্য। তখন সে খবর নিয়ে এসে বলে, ওস্তাদ,ওদের বাড়ি এখানে কোথাও নয়,ওরা এখানে বনভোজনে এসেছে। কিন্তু ওরা বাড়ি ফিরে না গিয়ে এখানে একটা হোটেলে উঠেছে। এটা শুনে বাচ্চুর মনে সন্দেহ আরো বেড়ে গেল। ওদের উপর কড়া নজর রাখার নির্দেশ দিল। সেই রাতে খাবার খাওয়ার পর সবাই মিলে পরামর্শ করতে লাগল যে এই ধাঁধার উত্তর কীভাবে খুঁজে পাওয়া যাবে। ধাঁধার কথাগুলো শোনার পর মনে হইতেছে যে গুপ্তধণ প্রাসাদের বাহিরে আছে। বাবুই তখন ধাঁধাটি পুনরায় পড়ল,”ধণ লোহিতে এসেছ যে, এসো হে আমার কাছে , আছি আমি প্রাসাদ থেকে কিছু দূরে,” এ পর্যন্ত পড়ে বোঝা গেল যে , প্রথম বাক্যে আমাদের সম্বোধণ করা হয়েছে। দ্বিতীয় বাক্যে তার কাছে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে, তৃতীয় বাক্যে সে কোথায় আছে তার সামান্য ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে। এর থেকে কিন্তু একটা জিনিস ভালো হয়েছে, আমরা গুপ্তধণ খুঁজবো কিন্তু আমাদেরকে বারবার প্রাসাদের ভিতরে যেতে হবে না,এতে করে ছেলেগুলো আমাদের সন্দেহও করতে পারবে না। ও মাই ফ্রেন্ড তুমি একদম ঠিক কথা বলেছ,পিটার বলল। বিট্টু বলল, আমরা হগগোলে এখন তাহলে শেষ লাইনটি মনোযোগ দিয়ে দেখি। যাইবে পুইড়ে বটগাছও আগুণে দিলে,কথাটার দ্বারা এখানে কী বোঝানো হয়েছে,তোরা কী কিছু বুঝলি ,বাবুই বলল। আমার মনে হয় বটগাছ বলতে সত্যি সত্যি বটগাছকে বোঝানো হয়েছে, নন্দু বলল। তা না হয় বুঝলাম কিন্তু বটগাছের সাথে আগুণের কী সম্পর্ক,পিটার বলল। সবাই যখন বটগাছ এবং আগুণ নিয়ে ভাবতে ব্যস্ত, তখন হঠাৎ বাবুই একটা গান ধরল————
আগুণ লেগেছে লেগেছে ………….আগুণ,দুম তা না না না না, আয় তোরা দেখে যা না,
জ্বলছে জ্বলছে দেখ, সব পুড়ে দেবে ডানা,প্রচন্ড তাপ কী কান্ড ভাব,কী কান্ড ভাব,
জ্বলে পুড়ে যায়(॥)
তোর হঠাৎ গান পেল, আমরা মরছি ধাঁধার উত্তর খোঁজার জ্বালায়।তবে যাইহোক গানটা কিন্তু অনেক ভালো। আগেরকার দিনের গান শুনলে মনটা ভরে যায়। কত সুন্দর করে আগে সুরকারেরা গান তৈরি করতেন, নন্দু বলল। আমার মনে হয় যেখানে বটগাছে আগুণ লাগে,সেখানেই মনে হয় গুপ্তধণ রাখা আছে। তুই কী যে বোকার মতো কথা বলিস না রে পিটার। এমন জায়গা কোথাও নেই,অন্য কিছু ভাব। তখন হঠাৎ বিট্টু বলল, এইহানে বটগাছ বলতে গাছ এবং আগুণ বলতে কোন দিককে বোঝানো হয় নাই তো ,আমরা ছোট্টবেলায় দশ দিক সম্পর্কে পড়েছিলাম যেমন : পূৃর্ব, পশ্চিম, উত্তর, দক্ষিণ, ঈশাণ, অগ্নি, নৈঋত, বায়ু, পাতাল। কিছু বুইঝা গেল,তোদের আরও একটু বুইঝা কইতেছি, দেখ এখানে আগুণ বলতে অগ্নি কোণকে বোঝানো হয়েছে। রাজা মাইষেরে বিব্রত করার লাইগাই এমন করেছেন। রাজা কইতেছেন যে, অগ্নি কোণে গেলে একটা বটগাছ পাওয়া যাবে। কিন্তু অগ্নি কোণ বলতে কোন কোণকে বোঝায় হেইটা তো আমার মনে নাই , তোরা কেউ মনে কর না। বাবুই তখন আনন্দে বলে উঠল হ্যাঁ, তুই ঠিকরে বিট্টু, এখানে আগুণ বলতে অগ্নি কোণকেই বোঝানো হয়েছে । আর অগ্নি কোণ হচ্ছে দক্ষিণ পূর্ব কোণ। তাহলে আজকের মতো আমাদের মিটিং শেষ। সবাই যে যার মতো ঘুমোতে যাও। আমরা সবাই কাল বিট্টুর কথামতো অগ্নি কোণে যাব , দেখব কোন বটগাছ পাই নাকি। সকলেই ঘুমিয়ে পড়ল । তাদের ঘরের পাশে বাচ্চু আঁড়িপেতে ছিল। তাদের সকল কথা সে শুনে ফেলে এবং মনে মনে বলে এতদিনে কিছু কাজের ছেলে পেয়েছি। যারা আমাকে গুপ্তধণ অবধি পৌঁছে দেবে।শেষ ভালো যার সব ভালো তার বলে বাচ্চু চলে যায় । পরেরদিন সকাল বেলা ওরা নাস্তা শেষ করে রাজ প্রাসাদ থেকে দক্ষিণ পূর্ব কোণে রওনা দেয় । কিছুদূর যাওয়ার পর দেখে মস্ত বড় একটা বটগাছ । বটগাছ দেখে সকলে আনন্দে হাততালি দিয়ে ওঠে এবং বলে বিট্টু তুই যুগ যুগ জিও । এবার ওরা বটগাছটার চারদিকটা ভালো করে দেখে এবং বাবুই বলে , হয় আমরা গুপ্তধণ এখানে পাব , নয়তো এখানে আর একটা ইঙ্গিত পাব,তোরা একটা জায়গাও বাদ দিবি না। সকলে খুঁজতে খুঁজতে এক পর্যায়ে ক্লান্ত হয়ে যায় এবং বটগাছটার নিচে বসে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য। নন্দু বলে, আমার ঘুম পেয়েছে আমি একটু ঘুমিয়ে নেই। তোরা খোঁজ । এই বলে সে যখন পিঠটা গাছে লাগাতে যাবে, দেখে অনেক ধুলা গাছটাতে ভরে রয়েছে । সে হাত দিয়ে ধুলা গুলো পরিষ্কার করতেগিয়ে দেখে যে কিছু একটা খোদাই করে রাখা এবং দেখে এটা আর একটা ধাঁধা । তখন সে সকলকে ডাক দেয় এবং ধাঁধাটি দেখায়। ধাঁধাটি হচ্ছে——————-
পেয়েছ বট , পেতে হবে মট,
সামনে জঙ্গল , পিছনে গুহা , মাঝে ছড়া,
করো দেখি তুমি কেমন পার ধাঁধা ।
ধাঁধাটি দেখে সকলে চমকে ওঠে এবং বলে এ কেমন ধাঁধা । আচ্ছা যাইহোক ধাঁধা যখন পেয়েছি এতেই হবে, চল আমরা এখন ফিরে যাই , বাবুই বলল । ফিরে এসে ওরা ধাঁধাটি নিয়ে বসল । আরে বাবা ধাঁধাটা পড়ে মনে হলো যে ,রাজা বুঝি আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছেন, পিটার বলল। যেহেতু এখানে মঠের কথা উল্লেখ রয়েছে তাই আমাদেরকে মন্দির নিয়েও ভাবতে হবে, হাসু বলল । আমার মনে হয় আগেরটা যেভাবে আমরা সমাধান করেছিলাম, এটা মনে হয় সেভাবে সমাধান করা যাবে না, কারন এখানে মঠ, জঙ্গল, গুহা শব্দ গুলো একে আপরের সাথে সংযুক্ত । আমারও তাই মনে হচ্ছে বাবুই । আমরা বরঞ্চ কাল আবার বটগাছের কাছে যাব এবং দেখব আশেপাশে কোন জঙ্গল বা মন্দির আছে নাকি, তারপর বাকি সিদ্ধান্ত নেওয়া যাবে, নন্দু বলল । পরের দিন সকালে তারা আবার বটগাছটার কাছে গেল এবং ওখান থেকে কিছুদূর এগিয়ে তারা একটা জঙ্গল দেখতে পেল । তারা সকলে জঙ্গলের ভিতরে যাওয়ার সময় বাবুই কী যেন একটা সন্দেহ করল কিন্তু কাউকে কিছু বলল না শুধু আঁড় চোখে পিছনে একবার তাকাল এবং সকলকে বলল, চল আমরা আজ ফিরে যাই । বাকি কাজ কালকে করব । বাবুইয়ের কথা মতো সকলে হোটেলে ফিরে এলো এবং বাবুইকে বলল , আমরা হঠাৎ কাজটা শেষ না করেই ফিরে এলাম কেন । তখন বাবুই বলল , চুপ দেওয়ালেরও কান আছে । তাই আমরা যা কিছু বলব তা যেন আমাদের “ক” জনের মধ্যেই থাকে । ঔ ছেলেটার কথা তোদের মনে আছে কী ? কোন ছেলের কথা বলছিস রে বাবুই, পিটার বলল । আরে ঐ ছেলেটা , প্রথম ধাঁধাটা খুঁজে পাওয়ার পর যে ছেলেদের সাথে দেখা হয়েছিল এবং যাদের কাছ থেকেই এই গুপ্তধণের ব্যাপারটা শুনেছিলাম । ও হ্যাঁ মনে পড়েছে ছেলেটির নাম বাচ্চু দলের প্রধাণ , নন্দু বলল । ঠিক বলেছিস ঐ ছেলেটি আমাদের এইসবের বিষয়ে জেনে গেছে । আমাদেরকে সবসময় চোখে চোখে রাখছে । আজকে ওকে ঐ জঙ্গলে লুকিয়ে আমাদের উপর নজর রাখতে দেখেছিলাম । তাইতো আমরা চলে এলাম। ছেলেগুলোকে আমার মোটেই সুবিধার বলে মনে হচ্ছে না । আর এটা কোন দুই চার পয়সা নয়, পুরো একটা রাজার সম্পত্তি । তাই আমাদের একার পক্ষে ঝুঁকি নেওয়া উচিত হবে না । পরে আমরাই বিপদে পড়ে যাব । বরঞ্চ আমরা একটা কাজ করি , পুলিশকে সবটা জানিয়ে দেই এবং তাদের সাথে নিয়েই কাল যাব গুপ্তধণের সন্ধানে । কথাটা তুই এক্কেবারে ঠিক কয়ছিস বাবুই । সবাই বাবুইয়ের সাথে একমত পোষণ করে । পরের দিন ঠিক সেভাবে কাজ করা হলো । পুলিশেরা জঙ্গলের পাশে একটা ঝোপের আড়ালে লুকিয়ে ছিল । বাবুই এবং তার বন্ধুরা ধাঁধার উত্তর খুঁজতে গেল । নন্দু বলল, ধাঁধাতে কী যেন বলা ছিল সামনে জঙ্গল , পিছনে গুহা তার মধ্যে আমরা জঙ্গল পেয়েছি । আমার মনে হয় জঙ্গলের পিছনে বা মধ্যে কোন গুহা আছে । চল আমরা সবাই খুঁজে দেখি । কথাটা মন্দ কছ নাই , চল আমরা খুঁজে দেখি,বিট্টু বলল। কিছুক্ষণ খোঁজার পর তারা একটা গুহার সন্ধান পায় । গুহাটি ছিল অনেক পুরানো এবং অন্ধকারাচ্ছন্ন । তাই তারা মশাল হাতে ঢুকে পড়ল। ঢুকে কিছুদূর এগোতেই তারা একটা মানুষের মূর্তি দেখতে পায় । বিট্টু বলে , আরে আমি তো এই মানুষটারে চিনি , হইতো সেই প্রাসাদের রাজা । তাহলে আমরা ভুল জায়গায় আসি নাই । সবার মন খুশিতে ভরে উঠল । রাজার মূর্তির উপর কী যেন লেখা । বাবুই মশালটা নিয়ে এগিয়ে গেলে দেখতে পারে । লেখাটি এরকম ——————————
তাকিয়ে পূর্বে , পড়বে ছড়া ,
খুলবে দরজা , করবে সুরাহা,
আছে হাতিয়ার , ভাঙ্গবে তালা,
করবে উদ্ধার হারানো সোনা ।
পিটার বলল , বোরো আমার মনে হয় এটা গুপ্তধণের কাছে পৌঁছানোর চাবি । যেরকম আরব্য রজনীর গল্পে আলীবাবা চিচিংফাঁক বলতে রাস্তা তৈরি হতো । ঠিক সেরকম কোন কিছু । আমারও তাই মনে হয় এই বলে বাবুই পূর্ব দিকে তাকিয়ে ছড়াটা পড়ার সাথে সাথেই গুহার একটা দেয়াল ফাঁক হয়ে গেল এবং ভিতর থেকে একটা আলোর ঝলক এসে তাদের চোখে লাগে । তারা সবাই এতো সোনারুপা দেখে অবাক । নন্দু বলে , ওরে ছালা এতো ধণ সম্পদ আমার চৌদ্দপুরুষ ও দেখে নাই । বিট্টু বলে , ঠিকই কয়ছিস ভাই আমার তো হার্ট ফেল হওয়ার অবস্থা হয়ে গেছে । হাসু বলে , আমায় একটু কেউ চিমটি কাট না । তখন পিছন থেকে কিছু লোকের আওয়াজ পাওয়া গেল , ওরা পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে সেই বাচ্চু আর তার দলবল । বাচ্চু বলে, তোদের সবাইকে ধন্যবাদ , আমার উপকার করার জন্য । তখন পিটার বলে তোমার উপকার মানে,গুপ্তধণ আমরা পেয়েছি, তাই এগুলো আমাদের । আহা বাবা তোরা ছোট বাচ্চা তোদের নাক টিপলে দুধ পড়বে , তোরা এতসব সামলাতে পারবি না । আর তা ছাড়া এই গুপ্তধণের জন্য আমি কতদিন হলো অপেক্ষা করে আছি । এখন আমি এগুলো বিদেশে পাচার করব এবং অনেক টাকা কামাব । তখন বাবুই বলল , কিন্তু এটা তো দেশের সম্পদ , কারো বাপের সম্পত্তি নয় । ব্যঙ্গস্বরে বাচ্চু বলল , সরকারের কাঁথায় গোবর । এগুলো এখন আমার । ঠিক তখন পুলিশ পিছন থেকে এসে ওর কলার ধরে বলে , কার কাঁথায় গোবর তা পরেই দেখা যাবে । আপাতত তোরা কারাগারের পিছনে চল । এই বলে পুলিশ ওদের ধরে নিয়ে যায় । সেই সাথে বাবুইদের এবং গুপ্তধণ গুলোকেও নিয়ে যায় । পরবর্তীতে বাবুইদের বুদ্ধি এবং সাহসিকতার জন্য সরকার তাদের পুরস্কৃত করে । যখন বাবুইরা তাদের পুরষ্কার নিয়ে গ্রামে আসে তখন সকলেই তাদের সাহসিকতার প্রশংসা করে । তারপর থেকে গ্রামের সকলে ওদের এক নামে চেনে , আর তা হলো বাবুইরা গোয়েন্দা । বাবুইরা গোয়েন্দা দলের নেতা বাবুই একদিন রাতে ঘুমাতে যায় এবং সেদিন স্বপ্নে আবার সে সেই রাজকন্যাকে দেখতে পায় । তার ছল ছল চোখের ঢল ঢল চাহনি বাবুইকে পাগল করে দেয় । তার ঠোঁট দুটো দেখলে মনে হয় যেন সদ্য ফোঁটা গোলাপের পাপড়ি । পুরো শরীরের রুপ লাবণ্য বাবুইকে শিহরিত করে মেয়েটি বাবুইকে ইশারা করে বলে ,তুমি ওখানে কেন , আমার কাছে এসো । আমি তোমার জন্যই এখানে অপেক্ষা করছি । এই কথা শোনার সাথে সাথেই বাবুইয়ের ঘুম ভেঙ্গে যায়। বাবুই মেয়েটির কথা ভাবতে থাকে এবং তার আশাতেই সারাক্ষণ পথ চেয়ে থাকে ।এরপর মাঝে মাঝেই মেয়েটি বাবুইয়ের স্বপ্নে আসে এবং তাকে কাছে ডাকে । বাবুইয়ের তীব্র আত্মবিশ্বাস একদিন মেয়েটিকে সে অবশ্যই সামনে পাবে । আর সে তার জীবনকে সেভাবেই এগিয়ে নিয়ে যায় । প্রতিদিন লেখাপড়া , তার সাথে প্রতিদিনের গানের অনুশীলন । তার এখন প্রিয় গান হচ্ছে ——————————————————
সে এক রূপকথারই দেশ , ফাগুণ যেথা হয় না কভু শেষ —
তারারই ফুল পাপড়ি ঝড়ায় সেথায় পথের ধারে ,
দেখে এলেম তারে , আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে—-
সাত সাগর আর তেরো নদী পারে , ময়ূরপঙ্খী ভিরিয়ে দিয়ে সেথা,
দেখে এলেম তারে , আমার স্বপ্নে দেখা রাজকন্যা থাকে!