জন্ম থেকেই দুই পা ও এক হাত বিকলাঙ্গ জাহিদুল ইসলামের। তিনি না পারেন দাঁড়াতে, না পারেন কোন কাজকর্ম করতে। তাকে চলাফেরা করতে হয় হাতের উপর ভর করেই। পঞ্চাশ বছর বয়সী জাহিদুলের থাকার ঘর না থাকায় আশ্রয় হয়েছে ভাইয়ের বাড়ির এক কোণে।
জাহিদুলের মতোই তার মা ছামছুন্নাহার বেগমও একজন শ্রবণপ্রতিবন্ধী। বছর পাঁচেক আগে হারিয়েছেন স্বামী। বাসযোগ্য ঘর না থাকায় তার রাত কাটে ঘোয়াল ঘরে; গবাদিপশুর সঙ্গে।
সেই ঘরটিও ভাঙা; টিনে ধরেছে মরিচা। ঘরটির কোথাও জোড়াতালির টিন; আবার কোথাও পাটকাঠির বেড়া। কোথাও সুপারি গাছের ছোবলা।
গত তিন মাস আগে হঠাৎ ঝড়ো বাতাসে এই গোয়ালঘরটি ভেঙে পড়ে। এরপর তাকে আশ্রয় নিতে হয় প্রতিবেশির গোয়ালঘরে। তার এই নিদারুণ কষ্ট দেখে তার মেয়ে জমিলা বেগম চড়া সুদে দাদনের টাকা নিয়ে ঘরটি মেরামত করে দেন। এখন সেই দাদনের লাভের অংশের টাকার চিন্তায় নির্ঘুম রাত কাটে মা-মেয়ের।
মেরামতের পরেও ঘরের চারপাশের খুঁটি-বেড়া নড়েবড়ে। ভাঙা টিনের বেড়ায় ধরেছে মরিচা। কোথাও টিন খুলে গেছে; আবার কোথাও ভেঙেছে পাটকাঠির বেড়া। দরজা-জানালা একদম খোলামেলা। ভেঙে পড়ে আছে কাঠের পাল্লা।
ঘরের চারপাশ দিয়ে চাঁদের আলো আর সূর্যের কিরণ অনাবরত হচ্ছে আলোকিত তার ঘর। ভাঙা বেড়ার ফাঁকে প্রতিনিয়তই উকি দেয় আলো-বাতাস। বেড়ার ফাঁক দিয়ে ঘরে প্রবেশ করে শেয়াল, কুকুর আর বিড়াল। এই ঘরের গবাদিপশুটিও বাস করতে পারছে না শেয়ালের উপদ্রবে।
মা-ছেলের জীবন কাটে বয়স্কভাতা আর প্রতিবন্ধী ভাতার টাকায়।
পাঠক বলছিলাম, গাইবান্ধার সাদুল্লাপুর উপজেলার দামোদরপুর ইউনিয়নের উত্তর দামোদরপুর গ্রামের শ্রবণপ্রতিবন্ধী ছামছুন্নাহার বেগম ও তার ছেলে বিকলাঙ্গ জাহিদুল ইসলামের কথা।
গ্রামবাসি জানায়, বৃদ্ধা ছামছুন্নাহার বেগমের কোন জায়গা জমি নেই। অন্যের বাড়িতে ঝি এর কাজ করে চলে তার সংসার। স্বামী আবদুল রশিদ মিয়ার মৃত্যুর পর বিকলাঙ্গ ছেলে জাহিদুল ইসলামকে নিয়ে তার সংসার। কিন্তু প্রতিবন্ধী ছামছুন্নাহার বয়সের ভারে ন্যুব্জ। বয়স সত্তর ছুঁইছুঁই। নিজেই চলতে পারেন না। তাই ছেলেকে পাঠিয়েছেন বড় ছেলে কৃষক সফিকুল ইসলামের বাড়িতে। সেখানে একটি ঘরে কোনমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়েছে তার।
এদিকে, ছামছুন্নাহার যে গোয়ালঘরে বসবাস করছেন; সেটি ঝড়ো বাতাসে ভেঙে যায়। এরপর চড়া সুদে দাদনের টাকায় সেটি মেরামত করেন। সে টাকা এখনও পরিশোধ করতে পারেননি তারা। মেরামতের পরেও গোয়ালঘরটি গবাদিপশুর জন্যও নিরাপদ নয়। অথচ সেই ঘরেই নিরুপায় হয়ে থাকতে হচ্ছে প্রতিবন্ধী বৃদ্ধা ছামছুন্নাহার বেগমকে।
অথচ তার বয়স্ক ভাতার কার্ড ছাড়া জোটেনি কিছুই। না পেয়েছেন সরকারি একটি ঘর, না কোনো সহায়তা। এখন তার দিন কাটে অর্ধাহারে, অনাহারে; খেয়ে না খেয়ে। সেই সাথে অর্থাভাবে দুই পা ও এক হাত বিকলাঙ্গ ছেলেকে কিনে দিতে পারেননি একটি হুইলচেয়ার। যার কারণে জন্মের পর থেকেই হাতের উপর ভর করে চলাফেলা করতে হচ্ছে জাজিদুল ইসলামকে।
মা ছামছুন্নাহার বেগম ও তার ছেলে জাহিদুল ইসলামের সহায়সম্বল বলতে গোয়াল ঘরটি ছাড়া কিছুই নেই।
এ নিয়ে বৃদ্ধা ছামছুন্নাহার বেগম বলেন, ‘হ; ভাঙিচুড়ি গেছিল ঘর। মানষের গোলত (গোয়ালঘর) আছনো। বেটি সুদের টেকা নিয়ে ঘর তুলি দিছি। তাও ঘরত বিলেই (বিড়াল) সানদায়, শিয়েল (শিয়াল) সানদায়; গাড়োয়া (বেজি) সানদায়। হাঁস-চড়াই থুবের পাই নে।’
মানষের বাত (বাড়ি) করিধরি খাই। ভাত পাই নে; কাপড় পাই নে। ভালোয় কষ্টত আছি। অসুখ! মাঝে মধ্যি পড়ি থাকি। অসুদ (ওষধ) পাই নে। বেটাঘরে (ছেলে) চলে না; তামরা কী দিয়ে আনি দেয়। নিজে কষ্ট করি খাই; চলি।’
তিনি আরও বলেন, ‘বেটাটাকও ভাত দিবের পাই নেই। হামি অচল; অসুখ। নিজে চলবের পাই নে। কী করি পালি। প্রতিবন্দি (প্রতিবন্ধী) বেটাটা আরাক ভাতত থাকে; ভাইয়ের ওটি। তারও চলে না। যন্তনা; ওংকরি চলা নাগে। কষ্ট; খুবিই কষ্ট বাবা!
তার ছেলে প্রতিবন্ধী জাহিদুল ইসলাম বলেন, ‘মায়ের তো ঘর-দুয়ের নাই। থাকার বুদ্ধি নাই। কুত্তে-শিয়েল সানদায় ঘরত। ভাঙা ঘর তুলি থাকে তাই (ছামছুন্নাহার)। হামি আচ্চি ভাইয়ের বাড়িত।’
‘মাও হামার বিদুয়ে (বিধবা) মানুষ। চলবের পায় না। অচল; কাজ-কাম করবের পায় না। কানে শোনে না।’
তিনি আরও বলেন, ‘মায়ের এনা ঘর-দুয়েরের আবদার করবের নাকছি। থাকার ব্যবস্থাটা করি দেন। তালি মাও-বেটা একঠাই থাককের পামো।’
ছামছুন্নাহার বেগমের পুত্রবধূ হাসিনা বেগম বলেন, ‘শ্বশুর তো মারা গেছি অনেক আগে। শ্বউড়ি (শাশুড়ি) এনা মানষের বাত কাম-কাজ করি খায়। বেটাঘরে (ছেলেদের) নাই; তামরা কী দেয়। একটা বেটার অসুখ; তাইও কাজ-কাম করবের পায় না। আরেকজন প্রতিবন্ধী। কীভাবে চলে। তার একনা ঘর আছিল সেকনাও তুবেনে (তুফান) পড়ি গেছি। কতদিন থাকি গোলত থাকে। ননদে (ননদ) নাগানি (দাদন) টেকা নিয়ে পুরেনা টিন দিয়ে কোন রকম চাল কোনা করি দিছে। তার বেড়া-টাটি নাই; ভাঙা-চুড়ে। কুত্তে সানদায়; শিয়েল সানদায়।’
প্রতিবেশি সায়দার রহমান বলেন, ‘তিনটে বেটা। দুটে তো গরীব; একটা প্রতিবন্ধী। তার তো চলি খাওয়ার মতো বুদ্ধি নাই। চাচিও তো ঠসা মানুষ। কষ্টের মধ্যে করি-মিলি খাচ্ছে।’
এ বিষয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক ও দামোদরপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান সাজেদুল ইসলাম স্বাধীন বলেন, ‘গোয়ালঘরে বৃদ্ধার বসবাসের সত্যতা পাওয়া গেলে তাকে ‘খ’ শ্রেণিভুক্ত ঘরের আওতায় আনা হবে।’
এ বিষয়ে সাদুল্লাপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. নবীনেওয়াজ বলেন, ‘ইতোমধ্যে ছামছুন্নাহার ও তার ছেলের ভাতার কার্ড হয়েছে। দ্রুত তার বাড়ি পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেয়া হবে।’