গাইবান্ধা শহর, সদর উপজেলার তুলশীঘাট, কামারজানি সহ জেলার ৭ উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার সহ অলিগলিতে ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠেছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের সহস্রাধিক ফার্মেসি বা ওষুধের দোকান। ৬০ থেকে ৭০টি রয়েছে শহরে লাইসেন্সবিহীন ঔষধের দোকান।
ঔষধ প্রশাসনের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে গাইবান্ধা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলার হাট- বাজারে অনেকেই ফার্মেসি দিয়ে বসেছেন ওষুধ বিক্রির ব্যবসায়। এসব ফার্মেসিগুলোয় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়া বা ব্যবস্থাপত্রে উল্লেখিত মেডিসিন না দিয়ে বিক্রয় করছে ভিন্ন মেডিসিন (ঔষধ) যেমন উচ্চমাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক, নিষিদ্ধ, ভারতীয়, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের নানা ধরনের ওষুধ বিক্রি করছে অবাধে। এ ছাড়া নেই কোনো প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট।
গাইবান্ধার বিভিন্ন স্থান ঘুরে দেখা গেছে- গাইবান্ধা শহর সহ জেলার ৭ উপজেলার হাটবাজার সহ বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে উঠেছে প্রশিক্ষণ ছাড়া ও ড্রাগ লাইসেন্সবিহীন শত শত ফার্মেসি। ফলে সাধারণ মানুষ প্রতিনিয়ত অপচিকিৎসার শিকার হচ্ছেন। বিশেষ করে সদর হাসপাতাল রোড, পালস ক্লিনিক ও এস,কেএস হসপিটালের সামনে, ভিএইড রোডে কয়েকটি লাইসেন্সবিহীন ঔষধের দোকান রয়েছে। গাইবান্ধার ডাক্তারদের কাছে ভিজিটের কারণে অনেকে জ্বর সহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হলে এলাকার শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, অন্তঃসত্ত্বারা ভিজিটের কারনে চিকিৎসকের কাছে আসেন না। তারা তাদের পার্শ্ববর্তী ফার্মেসির শরণাপন্ন হয়ে রোগের বর্ণনা দিয়ে ওষুধ নেন। এ সুযোগকে কাজে লাগাচ্ছে ফার্মেসিগুলো। গাইবান্ধা শহরসহ সদরের তুলশীঘাট, কামারজানি- পলাশবাড়ী, সাদুল্যাপুর, সাঘাটা, ফুলছড়ি, সুন্দরগঞ্জ, গোবিন্দগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন হাটবাজার ও মোড়ে কয়েক শতাধিক ফার্মেসির ড্রাগ লাইসেন্স ও ফার্মেসির প্রশিক্ষণ নেই।
ফার্মেসিগুলোয় চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র ছাড়াই উচ্চমাত্রায় এজিথ্রোমাইসিন অ্যান্টিবায়োটিক, ঘুমের বড়ি ও যৌন উত্তেজক ট্যাবলেট, নিষিদ্ধ, ভারতীয়, নকল, মেয়াদোত্তীর্ণ ও নিম্নমানের নানা ধরনের ওষুধ অবাধে বিক্রি করে আসছে। ফলে একদিকে যেমন ওষুধ ব্যবসায়ীরা হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা। অন্যদিকে সাধারণ ক্রেতারা প্রতারিত হওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুঁকি। ওষুধ নিয়ন্ত্রণ আইন ১৯৪০ অনুসারে কারও ওষুধের দোকান বা ফার্মেসি দেওয়ার ক্ষেত্রে তাকে নিম্নতম এইচএসসি পাশ করে প্রথমেই কমপক্ষে ছয় মাসের ফার্মাসিস্ট কোর্স করে সনদ সংগ্রহ করতে হবে। পরে সংশ্নিষ্ট ড্রাগ সুপারের কার্যালয়ে ফার্মাসিস্ট সনদ জমা দিয়ে ড্রাগ লাইসেন্সের জন্য আবেদন করতে হয়। ড্রাগ নিয়ন্ত্রণ অধ্যাদেশ ১৯৮২-এর ৪ নম্বরের ১৩ নম্বর ধারায় ‘ফার্মাসিস্টদের নিয়োগ’ শিরোনামে উল্লেখ আছে, কোনো খুচরা বিক্রেতা বাংলাদেশ ফার্মেসি কাউন্সিলের কোনো রেজিস্ট্রারের রেজিস্ট্রিভুক্ত ফার্মাসিস্টদের তত্ত্বাবধান ব্যতিরেকে কোনো ড্রাগ বিক্রি করতে পারবে না। কিন্তু এ নিয়মের তোয়াক্কা না করেই ওষুধ বিক্রি হচ্ছে এসব ফার্মেসিতে।
কয়েকজন সচেতন ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন ফার্মেসিতে আর বিশেষজ্ঞ লোকের দরকার হয় না। ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা বলে দেন কোন ওষুধ কী কাজে লাগে- সেই অনুযায়ী ওষুধ বিক্রি হয়। এ ছাড়া অনেক ওষুধের দোকানে নিম্নমানের ওষুধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা ওষুধ বিক্রি করে দেন। আবার অনেকে বেশি লাভের আশায় কমিটি গঠন করেছে। এতে করে পাইকারি দোকানগুলোয় বেশি মেডিসিন নিলেও আগের মত আর পাইকারী দাম নিচ্ছেনা তারা। ফলে অনেক গরীব রুগীদেরকে অতিরিক্ত অর্থ গুনতে হচ্ছে। ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে ভালোমানের ওষুধের চেয়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশ বেশি কমিশন নেওয়া হচ্ছে। এতে বেশি লাভের আশায় ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধ বিক্রিতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন ওষুধ ব্যবসায়ীরা। সাধারণ মানুষও কোন ওষুধটি আসল ও কোনটি ভেজাল তা চিহ্নিত করতে অপারগ। এর ফলে ভেজাল ও নিম্নমানের ওষুধের বাণিজ্য দিন দিন জমজমাট হচ্ছে। আর স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন সাধারণ মানুষ। গাইবান্ধা শহর সহ বিভিন্ন উপজেলার অবৈধ ফার্মেসিগুলো সাধারণ মানুষের অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যের ভেজাল ও মেয়াদোত্তীর্ণ ওষুধ বেশি মূল্যে বিক্রি করছে। যা রোগ নিরাময়ের পরিবর্তে উল্টো নানা উপসর্গের সৃষ্টি করছে। এ ছাড়া অসচেতন রোগীদের চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশনে উল্লিখিত ওষুধের একই গ্রুপের নিম্নমানের ওষুধ সরবরাহ করার অভিযোগও রয়েছে।
“গাইবান্ধা জেলা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তর অফিস উচ্চমান সহকারী আহসান হাবীব” জানান- গাইবান্ধা শহরসহ জেলার ৭ উপজেলায় কতগুলো লাইসেন্সবিহীন ঔষধের দোকান রয়েছে তা তাদের জানা নেই। রেজিষ্ট্রেশন তালিকায় আছে ১ হাজার ১শ ৬৬টি৷ নতুন রেজিষ্ট্রেশন তালিকায় ৪২ টি সহ মোট ১হাজার ২শ ৮টি। তিনি জানান- তারা অভিযানে যাওয়ার সাথে সাথে লাইসেন্সধারী দোকান সহ লাইসেন্সবিহীন দোকান সব বন্ধ হয়ে যায়।
“গাইবান্ধা জেলা কেমিস্ট এন্ড ড্রাগিষ্ট সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইফুল ইসলাম” জানান-গাইবান্ধা শহর সহ জেলার ৭উপজেলায় মোট ঔষধের দোকান রয়েছে ৫ হাজার। এর মধ্যে ১ হাজার ২শ টি লাইসেন্সকৃত। গাইবান্ধা শহরে লাইসেন্স বিহীন রয়েছে আনুমানিক ৬০ থেকে ৭০টি দোকান। বিভিন্ন সময় তারা ঔষধ প্রশাসন ও জেলা প্রশাসনকে লাইসেন্স এর আওতায় আনার জন্য এবং সহজভাবে লাইসেন্স দেয়ার দাবী করে আসছেন। যদি ঔষধের দোকানগুলো লাইসেন্স না করে তবে তাদেরকে উচ্ছেদ করার দাবী জানান।
গাইবান্ধা সচেতন নাগরিক কমিটির সহ-সভাপতি অশোক সাহা বলেন- আমার জানা মতে প্রতিটি ফার্মেসিতে একজন করে প্রশিক্ষিত ফার্মাসিস্ট থাকার কথা। সেখানে অধিকাংশ ফার্মেসিতেই ফার্মাসিস্ট নাই। এর বাইরে আবার লাইসেন্সবিহীন ফার্মেসি। যেখান থেকে ওষুধ কেনার পর কোন অঘটন ঘটলে কাউকে ধরার কোন উপায় নেই। আমরা মনে করি এসব ওষুধের দোকানে অভিযান পরিচালনা করে বন্ধ করে দেয়া উচিত। পাশাপাশি কঠোর আইনের প্রয়োগ করা উচিত যাতে করে অসহায় রোগীরা সঠিক এবং ভালোমানের ওষুধ কিনতে পারে।
গাইবান্ধা জেলা ঔষধ প্রশাসন অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধায়ক মোঃ মেহেদী হাসান জানান- লাইসেন্স প্রক্রিয়া একটি সময় সাপেক্ষ ব্যাপার। সবই লাইসেন্স এর আওতায় চলে আসবে। লাইসেন্সবিহীন ব্যবসায়ীদের লাইসেন্স এর আওতায় আনার জন্য ব্যবসায়ীদের সাথে মতবিনিময় করছি। সচেতন করছি। তারা যেন লাইসেন্স করে। লাইসেন্সের বিষয়ে কেউ গুরুত্ব দেয় আবার দেয়না। এতে করে রোগী ডাক্তার, শিক্ষিত মানুষদের সচেতন হতে হবে। সে সাথে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। লাইসেন্স করার জন্য নিয়মিত পরিদর্শনে যাওয়া হয়। ব্যবসায়ীদের সচেতন করি রোগীর যে সঠিক ওষুধ সেটা প্রদানের জন্য। ওষুধ মানুষের একটি প্রধান জিনিস। ভালো প্র্যাকটিস এর মধ্য দিয়ে রোগীকে ওষুধ দিবেন সে বুঝুক আর না বুঝুক। জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে মোবাইল কোর্ট চলমান আছে এবং মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি।
অন্যদিকে লাইসেন্স বিহীন ঔষধের দোকানে যাতে ঔষধ কোম্পানির রিপ্রেজেন্টেটিভরা মেডিসিন না দেয় এ ব্যাপারে কথা বললে তিনি বলেন- এটি একটা জাতীয় ও সামাজিক আন্দোলনের বিষয়। তবে এটি হওয়া উচিৎ। তাহলে তাদের প্রাক্টিস হবে ও লাইসেন্স করতে উদ্বুদ্ধ হবে।
“এ বিষয়ে গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক মোঃ আব্দুল মতিন” এর সাথে সরাসরি কথা বললে তিনি জানান- আমরা বিষয়গুলো জানি। যেগুলোর লাইসেন্স নেই সেগুলোতে ইতিমধ্যে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করেছি। তারা যেন লাইসেন্স করে এজন্য ড্রাগ সুপার ও সিভিল সার্জনকে নির্দেশ দিয়েছি এবং তাদের সমিতির সাথে মিটিং করেছি৷ এ ব্যাত্যয় ঘটলে আইনানুগ ব্যবস্থা নিব ও মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করব। এটা নিশ্চিত করবো। এ বিষয়ে আমরা আরো কঠোর হবো।
তিনি আরো জানান- লাইসেন্স প্রক্রিয়ায় অনেক জটিলতা রয়েছে। এটা আরও ইজিআর করলে মানুষ জন উদ্বুদ্ধ হবে। অনেকে ঢাকায় আবেদন করে বসে আছেন। আবেদন প্রক্রিয়া বিভাগীয় বা জেলা পর্যায়ে হলে সুবিধা হতো। এ পর্যায়ে নিয়ে আসা উচিত বলে তিনি মনে করেন।
বিডি গাইবান্ধা/