৬ নভেম্বর, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের সাঁওতাল পল্লীতে হামলা, লুটপাট-আগুন ও তিন সাঁওতালকে গুলি করে হত্যা ঘটনার পাঁচ বছর পূর্ণ হলো। কিন্তু এখনো হামলা ও হত্যা মামলা কোন অগ্রগতি নেই। গ্রেফতার হয়নি মামলার মূল আসামিদেরও। এমনকি বাপ-দাদার সম্পত্তিও ফিরে পায়নি সাঁওতালরা। বরং সেই জমিতে ইপিজেড স্থাপনের ঘোষণায় আবারো নতুন ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। বিচার কাজে দীর্ঘ সূত্রতা আর সম্পত্তি ফেরত না পাওয়ায় সাঁওতাল সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। হামলার ঘটনার পর থেকে কেউ অস্থায়ী জায়গা আবার কেউ বিরোধপূর্ণ জমি দখলে নিয়ে বসবাস করছেন। তবে দ্রুত মামলার বিচার কাজ শেষ করাসহ বাপ-দাদার সম্পত্তি ফেরতের জানিয়েছেন সাঁওতালরা।
২০১৬ সালের ৬ নভেম্বর সাবহবগঞ্জ খামারের জমিতে আখ কাটাকে কেন্দ্র করে সাঁওতালদের বসতবাড়িতে হামলা-ভাঙচুর ও লুটপাট চালানো হয়। আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয় সাঁওতালদের কয়েকশ’ বাড়িঘর। এসময় সাঁওতালরা-বাঙালিরা প্রতিরোধ গড়ে তুললে পুলিশ ও চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সংঘর্ষ বাঁধে। এতে পুলিশসহ উভয় পক্ষের অন্তত ৩০ জন আহত হন। এছাড়া পুলিশের ছোড়া গুলিতে মারা যান শ্যামল, মঙ্গল ও রমেশ নামে তিন সাঁওতাল। ঘটনার পাঁচ বছর পার হলেও সেদিনের হামলা আর তাণ্ডবের কথা আজও ভুলতে পারেনি হতাহত পরিবারের সদস্যরা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, হামলা, অগ্নিসংযোগ ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাঁওতালদের পক্ষে দুটি এবং পুলিশ ও চিনিকল কর্তৃপক্ষ ৮টি মামলা করে গোবিন্দগঞ্জ থানায়। এরমধ্যে সাঁওতাল হত্যা মামলাটির তদন্ত শেষ করে ২০১৯ সালের ২৩ জুলাই আদালতে প্রতিবেদন (চার্জশীট) দাখিল করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। কিন্তু চার্জশীটে এজাহার নামীয় গুরুত্বপূর্ণ ১১ আসামীকে বাদ দেওয়ায় তা প্রত্যাখ্যান করে ওই বছরের ৪ সেপ্টেম্বর আদালতে নারাজি দাখিল করেন মামলার বাদি থোমাস হেমব্রম। আদালত নারাজির ওপর শুনানি করে ২০১৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর মামলাটি পুর্ণ তদন্তের জন্য সিআইডিকে নির্দেশ দেয়। তদন্ত শেষে ২০২০ সালের ২ নভেম্বর সিআইডি আদালতে ওই ১১ জনকে বাদ দিয়েই চার্জশীট দাখিল করে। পরে আবারো সিআইডির দেওয়া তদন্ত প্রতিবেদনের বিরুদ্ধে গত ২০২১ সালের ৪ জানুয়ারী আদালতে একটি নারাজি পিটিশন করা হয়। আদালত শুনানী শেষে আগামী ৭ ডিসেম্বর ওই নারাজীর আদেশের জন্য দিন ধার্য্য করেন।
অন্যদিকে, আল জাজিরা টেলিভিশনে সাঁওতালপল্লীতে অগ্নিসংযোগের ভিডিও ফুটেজ প্রচারিত হলে বিষয়টি সুপ্রিম কোর্টের নজরে আসলে গাইবান্ধা চীফ জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেটকে তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়। তদন্ত শেষে ২০১৬ সালের ১৪ ডিসেম্বর তদন্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। তদন্তে পুলিশের এসআই মাহাবুব ও কনস্টেবল সাজ্জাদ হোসেনকে শনাক্ত করে প্রতিবেদন দাখিল করা হয়। এসময় জুডিসিয়াল তদন্তে অসহযোগিতার কারণে গাইবান্ধার পুলিশ সুপার আশরাফুল ইসলামকে বদলি করা হয়। এরপর অভিযুক্ত ২ পুলিশ সদস্যকে সাসপেন্ড করা হয়েছিল। কিন্তু পরবর্তীতে অভিযুক্ত পুলিশ সদস্যদের মামলার স্বাক্ষী করা হয়। সে সময় গোবিন্দগঞ্জ থানায় দায়িত্বরত ২২ পুলিশ সদস্য সহ পুলিশ সুপারকে অন্যত্র বদলি করা হয়।
এদিকে, মামলা অগ্রগতি ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ক্ষোভ বাড়ছে সাঁওতালদের মধ্যে। সেই সাথে বাপ-দাদার সম্পত্তি ফেরত না পাওয়ায় তাদের মধ্যে হতাশা আরও বেড়েছে। পাশাপাশির বাপ-দাদার জমিতে ইপিজেড করার ঘোষণায় নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে বলে অভিযোগ করেন সাঁওতালরা। ফলে জমি রক্ষায় আবারো আন্দোলন-সংগ্রামে নামতে হয়েছে সাঁওতালদের।
গত ১ নভেম্বর বিকেলে মাদারপুর ও জয়পুরপাড়ার সাঁওতাল পল্লীতে গিয়ে কথা হয়, বসবাসরত সাঁওতালদের সঙ্গে। মাদারপুর গির্জার সামনে আশ্রয় নেওয়া রফায়েল মুরমু, ইলিভা মার্ডি ও বার্নাবাস টুডু বলেন, তাদের বাপ-দাদার জমি রক্ষায় অনেক রক্ত দিয়েছে। দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন সংগ্রাম করে সম্পত্তি উদ্ধারে নেমে হামলার শিকার হতে হয়েছে। আগুনে শতশত বসতি পুড়িয়ে ফেলাসহ তাদের ওপর হামলা ও গুলি চালিয়েছে পুলিশসহ চিনিকলের শ্রমিক-কর্মচারী। এতে তিন সাঁওতাল প্রাণ দিয়েছে, আহত অবস্থায় শরীরে ক্ষত নিয়ে বেঁচে আছে অনেকেই। অথচ ঘটনার কোন বিচার হলো না আজও। জমি ফেরত দেওয়ারও উদ্যোগ নেই প্রশাসনের।
সাহেবগঞ্জ বাগদা ফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটির সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান আলী ও সাঁওতাল নেতা রাফায়েল হাসদার অভিযোগ, ঘটনার পর থেকেই পুরো জমি তাদের দখলে রয়েছে। সেখানে নিয়মিত ফসল উৎপাদন হচ্ছে। অথচ সেই দখলে থাকা জমি থেকে তাদের উচ্ছেদের চেষ্টা চলছে। তাদের দাবি, গোবিন্দগঞ্জে অনেক জমি পতিত রয়েছে সেখানে ইপিজেড স্থাপন করা হোক। তারা ইপিজেড স্থাপনের বিপক্ষে নন। তবে বিরোধপূর্ণ জমিতে ইপিজেড করতে রাজি নয় তারা।
মামলার বাদী থোমাস হেমব্রম বলেন, ঘটনার প্রায় ৬ বছর অতিবাহিত হয়ে যাচ্ছে। অদ্যবধি একজন আসামীকেও গ্রেপ্তার করা হয়নি। তৎকালীন স্থানীয় এমপি আবুল কালাম আজাদ ও তৎকালীন রংপুর চিনিকলের এমডি আব্দুল আউয়াল সহ ৩৩ জনের নাম উল্লেখ এবং ৫০০/৬০০ অজ্ঞাত আসামী করে থানায় এজাহার দাখিল করা হয়। কিন্তু প্রশাসন প্রভাবিত হয়ে ঘটনার সঙ্গে জড়িত মুল ১১জনকে বাদ দিয়ে আদালতে চার্জশীট দেন। আদালতে অভিযুক্তদের বাদ দিয়ে চার্জশীট দেওয়া হলে নারাজি করা হয়। আমরা আদালতে জুডিসিয়াল তদন্ত চেয়েছি। জুডিসিয়াল তদন্ত ছাড়া এ হত্যাকান্ডের সঠিক বিচার আমরা পাবো না।
আদিবাসী নেতা ডা. ফিলিমন বাস্কে বলেন, হামলা-লুটপাট ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেও উল্টো তাদের বিরুদ্ধে ৮টি মিথ্যা মামলা দিয়ে হয়রানি করছে পুলিশ ও চিনিকল কর্তৃপক্ষ। আহত অনেকেই হাত-পা ও চোখ হারিয়ে মানবেতর জীবন-যাপন করছে। তাদের এতকিছু ক্ষয়-ক্ষতির পরেও তারা সময়মত বিচার পাচ্ছে না। দ্রুত বিচার কাজ সম্পূর্ন করার পাশাপাশি সম্পত্তি ফেরত ও ক্ষতিপূরণের দাবি জানান তিনি।
আধিবাসী নেত্রী রিনা মার্ডি ও প্রিসিলা মুর্মু বলেন, উচ্ছেদের নামে নিরীহ আদিবাসীদের ওপর হামলা, লুটপাট ও বর্বরোচিতভাবে গুলি বর্ষণ করা হয়েছে। ঘটনার পর খোলা আকাশের নিচে ঝুপড়ি ঘর তৈরী করে শতশত সাঁওতাল পরিবার দিনাতিপাত করছে। সম্পত্তি রক্ষায় এখনো সাঁওতালদের মিছিল-মিটিং ও সমাবেশ করাসহ বিভিন্ন আন্দোলন করতে হচ্ছে। এই আন্দোলনের শেষ কোথায় তাও এখন অজানা তাদের কাছে।
আধিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ গাইবান্ধার আহবায়ক এ্যাডভোকেট সিরাজুল ইসলাম বাবু বলেন, সাঁওতাল বসতিতে গুলি-অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনার অবশ্যই বিচার হওয়া উচিত। অবিলম্বে এ হত্যাকাণ্ডের সব আসামিকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে বিচার শুরু করতে হবে। সাঁওতালরা এ দেশেরই পিছিয়েপড়া বঞ্চিত একটা অংশ। তাদের অস্তিত্ব ও অধিকার রক্ষায় সরকার বিশেষ উদ্যোগ নেবে, এটাই আমাদের প্রত্যাশা।
এদিকে, ৬ নভেম্বর এই দিনটিকে সাঁওতাল হত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে স্থানীয় সাঁওতালরা। এ উপলক্ষে শোক র্যালী, মোমবাতি প্রজ্জলন ও সমাবেশসহ দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছরের মতো এই কর্মসূচীর যৌথ আয়োজন করে সাহেবগঞ্জ-বাগদাফার্ম ভূমি উদ্ধার সংগ্রাম কমিটি, জাতীয় আদিবাসী পরিষদ, আদিবাসী ইউনিয়ন, জনউদ্যোগ, আদিবাসী-বাঙালি সংহতি পরিষদ, সিডিএন ও ক্যাপেং ফাউন্ডেশন।
বিডি গাইবান্ধা ডট নিউজ / সম্পাদক