গল্পঃ দহন
উম্মে মোসলিমা জ্যোতি
বাবা সকালে দ্রুত বেরিয়ে গেছেন। হঠাৎ গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হল। ঘরে বসে একমনে টিভি দেখছিল ছোটবোন। এসময় কেউ টিভিতে গুনগুনিয়ে গান করছিল। হঠাৎ বাবা এসে বললেন, তাঁর চশমাটা চট করে খুঁজে দিতে। আমার হাতে তখনো ময়দা লেগে আছে। ছোটবোন অদ্রিকে বললাম চশমাটা খুঁজে দিতে। অদ্রি তখনই ঘরময় চিরুনী অভিযান শুরু করল। আমি পরোটা ভাজছি। ছোটবেলাতেই মা মারা যাওয়ার পর বাবা আর বিয়ে করেন নি। বাবা আর ছেলে মিলেই বড় করেছি অদ্রিকে। বড় ভাই হলেও সংসার সামলানোর পুরো দায়িত্ব আমার ঘাড়েই আছে। আজ পর্যন্ত কোনোদিন রান্না ঘরে ঢুকে নি অদ্রি। হঠাৎই চোখ গেল রান্নাঘরের দরজার সরাসরি রাখা স্টিলের আলমারির আয়নাতে। দেখতে পেলাম বাবা নিজের বা হাতের তালুতে বন্দি করে রেখেছেন চশমাটাকে। আর অন্য হাতে ক্রমাগত চোখ মুছছেন। পাছে আমার আর অদ্রির চোখে সেটা পড়ে না যায়। আর তার দৃষ্টি টিভির পর্দায় গেয়ে যাওয়া মানুষটির উপর। বুঝতে আর কিছু বাকি রইল না। ধীর পায়ে বাবার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে ডাকলাম বাবাকে। বাবা কিছুটা চমকে উঠে শেষ অশ্রুবিন্দুটুকু মুছে ফেলার বৃথা চেষ্টা করলেন।
“এত কষ্টই যদি পাও তবে কেন দূরে সরিয়ে রেখেছো?” বললাম বাবাকে।
“সেটা তুমি বুঝবে না আবির।”
“এতটুকু বোঝার বয়স আমার হয়েছে বাবা। আমি জানি বাবা অদ্রি যদি এমনটা করে তাহলে হয়তো আমি সেটা কখনো মেনে নিতে পারবো না। কিন্তু একমাত্র বোনের যেটাতে সুখ সেটাকে কষ্ট হলেও হয়তো আমি মেনে নেব,”বললাম আমি।
“তুমি আমার জায়গাতে নিজেকে কল্পনা করতে পারো কিন্তু সে ঘটনা তোমার সাথে ঘটেনি বলে তুমি তার ব্যাপকতা উপলব্ধি করতে পারবে না।”
“কিন্তু বাবা….,” আমার কথা শেষ হওয়ার আগেই আমাকে থামিয়ে দিলেন বাবা। “থাক আবির, এসব নিয়ে এখন আর কথা বলে লাভ নেই। আমার অফিসের দেরি হয়ে যাচ্ছে। তুমিও হাতের কাজ শেষ করে চেম্বারে যাও। কর্মক্ষেত্রে কখনো গাফলতি করা ঠিক নয়,” বলতে বলতে চশমাটা চোখে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন বাবা। ইগো আর অপমানের কাছে আবারও ভালোবাসাকে পরাজিত হতে দেখলাম। জানি না বাবা কি কখনো ফুপিকে ক্ষমা করতে পারবেন কি না!
বুকে টেনে নিতে পারবেন নিজের আদরের ছোট বোনকে।
যেদিন ফুপু বাড়ি থেকে পালিয়ে ছিলেন সেদিন যে অপমান আর লজ্জায় পড়তে হয়েছিল সেটা হয়তো কখনো ভুলতে পারবেন না বাবা। মায়ের ছোট ভাই মানে আমার ছোট মামা কখনো এমনটা করবেন কখনোই সেটা ভাবতে পারেন নি বাবা, মা কিংবা আমাদের পরিবারের কেউ। সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরেই মা পাড়ি জমান ওপারে। যখন টিভিতে ফুপির গান বাজে তখন বাবাকে নীরবে চোখের জল ফেলতে দেখি। এই চোখের জল বাষ্প হয়ে উড়ে যায় পুরনো ক্ষতের জলন্ত শিখায়।
“কিরে ভাইয়া বাবা চলে গেল! চশমা পেলেন?” বাবাকে দেখতে না পেয়ে জিজ্ঞেস করলো অদ্রি।
“হ্যাঁ, চশমা বাবার পকেটেই ছিল,” উত্তর দিলাম ওকে।
“অহ, তাই বল। বাবা দিন দিন ভুলোমনা হয়ে যাচ্ছেন। কিছুই মনে থাকে না। জানিস ভাইয়া কাল রাতে আমায় বললেন যেন ঠিক বারোটায় বাবাকে মনে করিয়ে দিই, কার যেন জন্মদিন। কিন্তু যখন বারোটায় ডাকতে গেলাম তখন বললো, কার জন্মদিন!কিসের জন্মদিন! তিনি নাকি আমায় কিছুই বলেন নি!”
“তাই নাকি!” অবাক হলাম অদ্রির কথায়।
“হ্যাঁ তাই,” সায় দিল অদ্রিও।
পরোটা পুড়ে যাওয়ার গন্ধ আসছে, দ্রুত রান্নাঘরে ছুটে গেলাম। আর তখনই মনে পড়ল আজ ফুপির জন্মদিন।